
প্রকাশিত: Tue, Dec 20, 2022 3:32 PM আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 12:09 PM
লিও মেসি-ম্যারাডোনাদের নিঃশর্তে ভালোবেসে, জিতে গেলো বাংলাদেশ!
ভূঁইয়া আশিক রহমান
[২] উষ্ণ এই ভালোবাসা বুকে পুষে রখেছিলো। যত্ন করছিলো। শর্তহীন ভালোবাসার প্রকাশ ঘটছিলো। ১৯৮৬ সালের পর থেকেই, ম্যারাডোনা যখন ফুটবল বিশ^কাপ জিতলেন। আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনা এ দেশের মানুষের মনে ঠাঁই নিলো। ভালোবেসে সেই যে হৃদয়ের কথা বলতে শুরু করলো এ দেশের মানুষ, শত ব্যর্থতা আর প্রতিপক্ষের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও দমাতে পারলো না। কী যাদুমন্ত্র করেছিলেনÑফুটবল ঈশ^র ম্যারাডোনা। বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমিকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন, চিরকালীন ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন।
[৩] ম্যারাডোনা খেলার মাঠ ছেড়ে আসার পর অনেক খেলোয়াড়ই আর্জেন্টিনা দলে এলেন-গেলেন। কিন্তু ম্যারাডোনার মতো জাদুমন্ত্র নিয়ে কি কেউ হাজির হতে পেরেছিলেন? কেউ কেউ সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন বটে, প্রতিভা অনেকেরই ছিলো, কিন্তু কেউ আর ম্যারাডোনা হতে পারলেন না। ম্যারাডোনা কাছাকাছিও যেতে পারলেন না। অবশেষে তিনি এলেন। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা রূপে! কে তিনি? ফুটবল জাদুকর। কী নাম তাঁর? লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। এ কী উন্মাদনা, এ কী মাদকতা, কী এক যাদুমন্ত্রণায় লিও মেসি মুগ্ধতা ছড়াতে লাগলেন পায়ের জাদুতে। বিশ^ বুঁদ হলো মেসি নামক এক ক্ষুদে জাদুকরের যাদুর খেলায়। মানুষ মেসি অভিধা পেলেন, ভিনগ্রহের ফুটবলারের!
[৪] বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও মেসি প্রেমে মাতাল হলো। বিশ^কাপ এলেই বাড়ির আঙিনা, বাসার ছাদে ছাদে আর্জেন্টিনার পতাকা উড়তে থাকে। বিশ^কাপ যখনই আসে, কার্যত সব ছেড়েছুঁড়ে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে আবেগে ভাসে। সমর্থিত দলটি পরাজিত হয়, প্রথম রাউন্ড থেকেও ফিরতি টিকিট কেটে বাড়ি ফিরে, তবুও কোনো ক্লান্তি নেই। হতাশায় খানিক দম নিলেও আবারও জেগে ওঠে। আবারও স্বপ্ন দেখে, একদিন বিশ^জয় করবেই ম্যারাডোনার উত্তরসূরীরা। ম্যারাডোনা পেরেছিলেন, মেসি-ডি মারিয়ারা পারবেন না বিশ^ জয় করতে? পারবেন, অবশ্যই পারবেন একদিন বিশ^জয়ের আনন্দে ভাসতে। সমর্থকদের উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ্য তৈরি করতে। বিশ^াস ছিলো হৃদয়ে। বিশ^াসের জয় না হয়ে পারে নাÑ এই বিশ^াসেই জোর সমর্থন অব্যাহত রাখে সমর্থকেরা। কারণ ভালোবাসা অনিঃশেষ!
[৫] ২৬টি গোল কোপা ও বিশ^কাপ আসর মিলিয়ে। কেবল আর্জেন্টিনা নয়, পুরো লাতিন আমেরিকান ফুটবলার হিসেবে এই গোলের রেকর্ড এখন লিও মেসির। ব্রাজিল কিংবদন্তি রোনাল্ডোর সম্মিলিত গোল সংখ্যা ২৫টি। ক্ষুদে জাদুকরের ক্যারিয়ারে দশটি লা লিগা, একটি ফ্রেঞ্চ লিগ, সাতটি কোপা দেল রে, সাতটি সুপারকোপা, চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, তিনটি উয়েফা সুপার কাপ, তিনটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ, একটি অলিম্পিক ফুটবলে স্বর্ণজয়ী, একটি কোপা আমেরিকাÑকী বাকি ছিলো লিওর সাফল্যের ঝুলিতে? সব, সবকিছুই অর্জন করেছিলেন। কিন্তু ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৫টি বিশ^কাপ খেললেও সমর্থকদের বহুদিনের স্বপ্নপূরণ করতে পারছিলেন মেসি-ডি মারিয়ারা। ২০১৪ সালে বিশ^জয়ের খুব কাছে গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছিলো। ২০১৮ সালে রাউন্ড সিক্সটিন থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিলো। লিও মেসি হতাশা থেকে অবসরই নিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ফিরলেন আবারও। কেন? কারণ বিশে^র শতকোটি ভক্ত-সমর্থকেরা যে মানতে পারছিলো না ফুটবল জাদুকরের মুকুটে বিশ^কাপ ফুটবল জয়ের ইতিহাস থাকবে না। মেসিও মানতে পারছিলেন না। মেনে নিতে পারছিলেন না তার প্রিয় সতীর্থরাও। যে কারণে কোপা জিতানো গোলকিপনার এমি মার্তিনেজ বলেছিলেন, ‘মেসির জন্য তিনি জীবন দিতেও প্রস্তুত! মেসির জন্য তারা জানপ্রাণ উজাড় করে খেলবেন। বিশ^কাপ তাদের চাই, চাই-ই’! সখী ভালোবাসা কারে কয়, দেখিয়েছেন মেসি সতীর্থরা।
[৬] মন থেকে পণ করলে সাফল্য মিলে? কখনো কখনো সমীকরণ মিলে না, তবে বেশির ভাগ সময়ই চেষ্টার যোগফল মিলে। আর্জেন্টিনার ভক্তদের মুখেও হাসি ফুটতে শুরু করে। টানা ৩৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাতার বিশ^কাপ অংশগ্রহণ করতে লিও মেসিরা এলেন। প্রথম রাউন্ড অনায়সেই পার হয়ে যাবেনÑএমন সমীকরণ থাকলেও সৌদিরা কাঁটা হয়ে বিঁধলেন মেসি-ডি মারিয়াদের বুকে। রক্তক্ষরণ হলো। রব উঠলো, মেসি কোথায়, মেসি? মেসি থাকলে, কীভাবে পুচকে সৌদি আরবের সঙ্গে আর্জেন্টিনা হারে! এই বিশ^কাপও আর্জেন্টিনা শূন্য হাতে ফিরবে, মেসি আর পারবেন না। এই খেলা দিয়ে বিশ^কাপ জয়ের স্বপ্ন কেবলই দূরাশা! কতো কতো কথা, কতো কতো অপমান। লাঞ্ছনা। ট্রলের শিকার হতে হয়েছে বিশ^ব্যাপী আর্জেন্টিনার সমর্থকদের। কেউ কি হিসাব রাখেন!
[৭] কাতার বিশ^কাপে সমালোচকরা মেসিদের কোনো আশা কিংবা ভবিষ্যৎই দেখছিলেন না। কারণ সৌদি আরবের সঙ্গে হেরে যাওয়ার পর প্রতিটি ম্যাচই নকআউট হয়ে যায় আর্জেন্টিনার জন্য। হারলেই বিদায়। এক রুদ্ধশ^াস পরিস্থিতি তৈরি হয়। কী হবে মেসির বিশ^কাপ জয়ের স্বপ্ন? আর্জেন্টিনা কি সত্যিই কাতার বিশ^কাপ থেকে বিদায় নেবে? প্রথম রাউন্ড থেকেই! মনে হাজার প্রশ্ন থাকলেও মেসিরা ঘুরে দাঁড়ানোর পণ করলেন। সমর্থকেরাও পাশে দাঁড়ালো। এগিয়ে যাওয়ার জন্য মনপ্রাণ উজাড় করে সমর্থন দিতে লাগলো। লিও মেসিরা ভালোবাসার ডাক শুনলেন। প্রথম রাউন্ড, রাউন্ড সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালও খেলে ফেললেন। যে দলটিকে প্রথম রাউন্ড থেকেই ফিরতি টিকিট দেখিয়ে দিয়েছিলো নিন্দুকেরা, সেই তারা ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করলো। মেসি নামক ফুটবল জাদুকরের অনন্য নৈপূণ্যে। অবশেষে বিশ^কাপ পেলেন, মহাশক্তিধর ফ্রান্সকে হারিয়ে ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান হলো। বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমর্থকেরা আনন্দে ভাসলো। অকাতরে ভালোবাসা বিলানো এ দেশের সমর্থকেরাও খুশিতে চোখের জল ফেললেন। ফুটবল জাদুকরের স্বপ্নও পূরণ হলো। একইসঙ্গে অষ্টমবারের মতো ‘ব্যালন ডি অর’ খেতাব জয়ের হাতছানিও এখন লিও মেসির। [৮] বাংলাদেশের মানুষ আর্জেন্টিনা ফুটবল দল, মেসি-ম্যারাডোনাদের ভালোবেসে গেছে, কোনো কিছু পাবার আশা না করেই। এই ভালোবাসা শর্তহীন। সুদমুক্ত ভালোবাসা। অকৃত্রিম এই ভালোবাসার গল্প আর গোপন থাকেনি, ৩৬ বছর ধরে মেসি-ম্যারাডোনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাওয়ার এই খবর বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে গেলো কাতার বিশ^কাপ চলাকালে। আর্জেন্টাইনরা জানলো, তাদের বিনাশর্তে ভালোবাসে বাংলাদেশ। বিনিময়ে তারাও ভালোবাসার বার্তা পাঠাতে থাকে নিঃসংকোচচিত্তে। আর্জেন্টিনা সরকার, দেশটির ফুটবল ফেডারেশন, কোচ, দল, দর্শক, মেসির বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরা। কে নেই সেই তালিকায়। সব ভালোবাসা আছড়ে পড়তে থাকে বাংলাদেশে। বিশ^জয়ের পর কাতারে একখণ্ড আর্জেন্টিনাকে দেখা যায়, সেখানেও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শ্লোগানে কাতার কাঁপিয়েছিলেন আর্জেন্টাইনারা।
মেসিরা নিজের দেশে পৌঁছে গেছেন। লাখ লাখ জনতা রাস্তায়। মেসি-ডি মারিয়াদের স্বাগত জানাচ্ছে। ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বিশ^জয়ের পরও অকৃত্রিম বন্ধু বাংলাদেশের সমর্থকদের ভুলে যাননি তারা। আর্জেন্টিনার যেখানেই উৎসব, সেখানেই লাল-সবুজের পতাকা। পত পত করে উড়ছে আর্জেন্টিনার আকাশে। আর্জেন্টাইনরা ভালোবাসা জানাচ্ছে বাংলাদেশকে। তারা বলছেন, ভালোবাসি বাংলাদেশ। মেসি, ম্যারাডোনা কিংবা আর্জেন্টিনাকে ভালোবাসে যারা, মন থেকেই তোমাদের ভালোবাসি। আর্জেন্টিনা-বাংলাদেশ ভাই ভাই। কতো কতো ভালোবাসা। এই ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। নেই কোনো ছলচাতুরি। অকৃত্রিম ভালোবাসা বিলিয়ে বিশ^জয় বাংলাদেশের। আর্জেন্টিনা, মেসি-ম্যরাডোনারা এখন বাংলাদেশের পরমাত্মীয়। খুব কাছের স্বজন। সুজন। নিঃস্বার্থ এই ভালোবাসা বেঁচে থাক। লিও মেসি-ম্যারাডোনাদের নিঃশর্তে ভালোবেসে, জিতে গেলো বাংলাদেশ! ভামোস আর্জেন্টিনা। ভামোসÑবাংলাদেশ। লেখক: সাংবাদিক
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
